পুলিশের চেকপোস্ট ভেতরে মাদক কারবার
প্রতিদিনই ক্যাম্পের ওপর চলছে কড়া নজরদারি। ইয়াবা বা অন্য মাদক কারবারির তথ্য পেলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত তিন মাসে এভাবে অর্ধশতাধিক মাদক কারবারিকে আটক করা হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত ক্যাম্পে প্রচারণা চালানো হয় মাদক থেকে সরে আসতে।
কিন্তু তার পরও ক্যাম্প থেকে মাদক নির্মূল করা যাচ্ছে না। তদন্তে উঠে এসেছে, ক্যাম্পের অন্তত ৬০ শতাংশ লোক প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মাদকের সঙ্গে যুক্ত। গত বুধবার কালের কণ্ঠকে কথাগুলো বলছিলেন মহানগর পুলিশের মোহাম্মদপুর থানার বিট পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক পুলিশ কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পর সরেজমিনে মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে আড়ালে-আবডালে চলছে মাদক কারবার। তবে পুলিশ ও র্যাবের নজরদারির কারণে ক্যাম্পে মাদক কারবারের ধরন পাল্টেছে। আগে জেনেভা ক্যাম্পে প্রকাশ্যে মাদক কারবার চললেও এখন চলছে আড়ালে-আবডালে।
গত বুধবার রাতে ক্যাম্পের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, সরু সরু গলির দোকানগুলোয় লুকিয়ে চলছে ইয়াবা বিক্রি। ক্যাম্প ঘিরে থাকা গজনবী রোড, বাবর রোড, শাহজাহান রোড, হুমায়ুন রোডে রয়েছে পুলিশের ক্যাম্প এবং তল্লাশি চৌকি। কিন্তু কিছুরই তোয়াক্কা করছে না ক্যাম্পে বসবাসকারীরা। অনেকটা মরিয়া হয়েই তারা চালিয়ে যাচ্ছে মাদক কারবার।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার হারুন অর রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শুধু জেনেভা ক্যাম্প নয়, রাজধানীর সব এলাকাকে মাদকমুক্ত করতে আমরা তৎপর। প্রতিনিয়ত নজরদারি করা হচ্ছে। মাদক কারবারে যারাই জড়িত, তাদের গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে।’
এর আগে গত ডিসেম্বরে সরেজমিনে জেনেভা ক্যাম্প ঘুরে প্রকাশ্যে মাদক কারবার ও মাদকসেবীদের লেনদেনের দৃশ্য দেখা গেছে। ওই সময় জানা যায়, অন্তত ২০ জন কারবারির নিয়ন্ত্রণে জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবার। আটকে পড়া এসব অবাঙালিকে নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের এক নেতা জানান, চক্রটি মোহাম্মদপুরের ছয়টি আটকে পড়া অবাঙালি ক্যাম্পের মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে। গত বুধবার দুই দফায় ফের মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে গিয়ে দেখা গেছে, আগের মতো প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে ঠিকই চলছে মাদক বেচাকেনা।
বুধবার রাত ৯টা। জেনেভা ক্যাম্পের জনাকীর্ণ একটি গলিতে প্রবেশ করতেই নজরে পড়ে কয়েকজন সন্দেহভাজন লোক। ওই গলির মধ্যেই একটি দোকানের পেছনে ছোট্ট একটি ঘরের দরজার সামনে দুই কিশোরকে কিছু একটা লেনদেন করতে দেখা গেল। অনুসন্ধান করে জানা গেল, ওই দুই কিশোরের একজন আরেকজনের কাছে ১০টি ইয়াবা বিক্রি করেছে। এদের একজনের নাম সোলেমান, অন্যজনের নাম জুম্মন। ক্যাম্পের সবাই তাদের চেনে।
ক্যাম্পে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে মোল্লা আছাদ, শাহজাদা, খোরশিদ, মুন্না, পাপ্পু ও তার ছেলে রাসেল, চুয়া সেলিম, তুতে, কাল্লু, রাজু ও রাজা নামের দুই ভাই, আতিক, রেহানা, রানা, বালম ও তাবলচি আসলাম, গালকাটা মনু নিয়ন্ত্রণ করছে জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবার। এদের কাছ থেকে মাদকদ্রব্য সংগ্রহ করে বাইরে বিক্রি করে আরো শতাধিক নারী-পুরুষ।
জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবার কেন নিয়ন্ত্রণে আসছে না, জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার বিট পুলিশিংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপপরিদর্শক (এসআই) জহির রায়হান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিয়মিত অভিযানের ফলে ক্যাম্পে এখন মাদক কারবার অনেকটা কমেছে। এ এলাকাকে মাদকমুক্ত করতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে।’
মোহাম্মদপুর থানার ওসি মো. আব্দুল লতিফ বলেন, নিয়মিত অভিযান আর কঠোর নজরদারির কারণে জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবার এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। সেই সঙ্গে নিয়মিত সামাজিক বৈঠকের মাধ্যমে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে।
এদিকে এসপিজিআরসি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এম শওকত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পে বসবাসকারীরা নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের অনেকে লেখাপড়া জানে না, কেউ লেখাপড়া জানলেও কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। তাই জীবিকার তাগিদে তারা ঝুঁকি নিয়ে মাদক কারবারের মতো অপরাধে জড়িয়েছে।’
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন বলেন, ‘মাদক কারবারসহ অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণে দরকার কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তা, সেই সঙ্গে দরকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সঠিক নজরদারি।’